ডায়াবেটিস হল আমাদের শরীরের একটা মেটাবলিক ডিজিজ। সাধারনত আমাদের রক্তে নির্দিষ্ট মাত্রার গ্লুকোজ বা সুগার থাকে। যখন এই সুগারের পরিমান নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করে বেড়ে যায় , তখন এটাকে ডায়াবেটিস বলা হয়। এটাকে বাংলায় বহুমূত্র রোগও বলে।
আমাদের শরীরের প্যানক্রিয়াস যখন ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে না অথবা আমাদের শরীরের কোষগুলো যখন উৎপাদিত ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না , তখনই রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যায়। আমরা কিছু খাবার পর , শরীর সেটা ভেঙ্গে গ্লুকোজ উৎপাদন করে , এই গ্লুকোজ রক্তের মাধ্যমে ইনসুলিনের সাহায্যে শরীরের বিভিন্ন কোষে প্রবেশ করে। আর এভাবেই আমরা শরীরে এনার্জি বা শক্তি পাই। ডায়াবেটিস হলে মূলত আমাদের এই সিস্টেমেই ব্যাঘাত ঘটে । অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডায়াবেটিস লাইফ লং ডিজিজ অর্থাৎ সারাজীবনই এই রোগ নিয়ে থাকতে হয়।
বিস্তারিত জানুন: ডায়াবেটিস প্রতিরোধ
ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) এর মতে ২০২৩ সালে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে মারা গেছে । বর্তমানে প্রায় ৫৩ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগতেছে। প্রতি ১০ জনে ১ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ২০৪৫ সালে এটা ৭০ কোটিতে পৌছাবে।
২০১৯ সালে সারাবিশ্বে ডায়াবেটিস চিকিৎসার জন্য কমপক্ষে ৭২০ বিলিয়ন ডলার ( ৮৬ লক্ষ কোটি টাকা) ব্যয় হয়েছে।
বাংলাদেশে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা অনেক বেশি । বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১ কোট ৩২ লাখ ডায়াবেটিসের রোগী আছে (স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০২৩ তথ্য অনুযায়ী)। এছাড়া প্রায় সমপরিমান রোগী আছে যাদের ডায়াবেটিস আছে , কিন্তু তারা জানে না।
বিস্তারিত জানুন: ডায়াবেটিস জটিলতা
ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরনেরঃ
টাইপ – ১ ডায়াবেটিসঃ টাইপ -১ ডায়াবেটিসে আমাদের শরীর সাধারনত কোন ইনসুলিন উৎপাদনই করতে পারে না কিংবা শরীরের চাহিদা অনুযায়ী খুবই সামান্য ইনসুলিন উৎপাদন করে। এটা সাধারনত হয়ে থাকে যখন প্যানক্রিয়াসের ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায় । মূলত শরীরেরর অটোইমিউন সিস্টেম যখন ভালভাবে কাজ না করে তখন এমন হয়ে থাকে । যেহেতু শরীরে কোন ইনসুলিন উৎপাদন হচ্ছে না , ফলে আমরা যেই খাবার খাচ্ছি সেখান থেকে গ্লুকোজ আমাদের শরীরের কোষে প্রবেশ করতে পারছে না এবং আমাদের শরীরের কোষগুলো এনার্জি পাচ্ছে না। আমরা দুর্বল হয়ে যাচ্ছি । এই গ্লুকোজ শরীরের কোষে প্রবেশ করার জন্য ইনসুলিন অত্যাবশ্যকীয় । আর এই কারনেই টাইপ -১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে বাহিরের থেকে শরীরে ইনসুলিন পুশ করতে হয়। মোট ডায়াবেটিসের ৫-৭% টাইপ -১ ডায়াবেটিস। টাইপ -১ ডায়াবেটিস বাহিরের থেকে ইনসুলিন নেওয়া ছাড়া নিয়ন্ত্রন সম্ভব নয়। তবে এক্সারসাইজ করলে অবশ্যই উপকৃত হওয়া যায়।
টাইপ – ২ ডায়াবেটিসঃ টাইপ – ২ ডায়াবেটিস হয় মূলত ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের জন্য।
ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হল আমাদের শরীরের এমন একটি অবস্থা , যেখানে প্যানক্রিয়াস ইনসুলিন উৎপাদন করে ঠিকই কিন্তু আমাদের শরীরের কোষগুলো উৎপাদিত ইনসুলিনকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে না।
ইনসুলিন কাজ না করার কারণে শরীরের কোষে গ্লুকোজ প্রবেশ করতে পারে না , যার ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায় । কারণ এই ইনসুলিনের কাজই হল রক্ত থেকে গ্লুকোজকে শরীরের কোষে প্রবেশ করানো। শরীরের কোষগুলো এই গ্লুকোজকে শক্তি হিসেবে গ্রহন করে বেঁচে থাকে।
ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনে মতে ৯০% এর বেশি টাইপ-২ ডায়াবেটিস। কোন কোন গবেষনা অনুযায়ী ৯৫% এর বেশি টাইপ -২ ডায়াবেটিস।
নিয়মিত এক্সারসাইজ , জীবনযাত্রার পরিবর্তন , সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং আধুনিক কিছু থেরাপির মাধ্যমে টাইপ -২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রন করা যায়। অত্যাধুনিক কিছু থেরাপি – যেমনঃ ওজোন থেরাপি , আকুপাংচার থেরাপি , ম্যাগনেটিক এনার্জি থেরাপি এবং ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে ডায়াবেটিস পরবর্তী জটিলতা অনেকটাই কমানো সম্ভব।
এছাড়া আরোও কিছু ডায়াবেটিস আছে , যেমন – জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস , নিউনেটাল ডায়াবেটিস। জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস সাধারনত গর্ভবতী মায়েদের হয়ে থাকে। সন্তান প্রসবের পর এটা অটোমেটিক ভাল হয়ে যায়। তবে গ্যাস্ট্রেশনাল ডায়াবেটিস রোগীদের পরবর্তীতে টাইপ -২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ছোট বাচ্চাদের অনেক সময় ডায়াবেটিস থাকে এটাকে নিউনেটাল ডায়াবেটিস বলে । তবে এটা খুবই কম দেখা যায়।
বিস্তারিত জানুন: ডায়াবেটিস ফুট আলসার
আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি – ডায়াবেটিস মানেই আমাদের রক্তে গ্লুকোজের (সুগার) পরিমান নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেড়ে যাওয়া। এখন প্রশ্ন হল এই গ্লুকোজের
লেভেল কেন আমাদের রক্তে বেড়ে যায়।
১) ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সঃ আমাদের ডায়াবেটিসের ৯০% এর বেশি ডায়াবেটিস হল টাইপ ২ ডায়াবেটিস । এই টাইপ ২ ডায়াবেটিসের মূল কারণ হল ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স।
ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হল আমাদের শরীরের এমন একটি অবস্থা , যেখানে – প্যানক্রিয়াস ইনসুলিন উৎপাদন করে ঠিকই কিন্তু আমাদের শরীরের কোষগুলো ইনসুলিনকে ভালভাবে গ্রহন করতে পারে না । ভাল্ভাবে গ্রহন না করার কারণে ইনসুলিন রক্ত থেকে গ্লুকোজকে শরীরের কোষে প্রবেশ করাতে পারে না এবং টিস্যু গুলো তাদের প্রয়োজনীয় এনার্জি পায় না । টিস্যূতে গ্লুকোজ প্রবেশ না করার কারণে রক্তে গ্লুকোজের (সুগার) পরিমান বাড়তে থাকে , এটাই টাইপ -২ ডায়াবেটিস । এখন প্রশ্ন হল – ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কেন হয় –
২) অটোইমিউন রোগঃ ইমিউন সিস্টেম হচ্ছে আমাদের শরীরের এমন একটি অংশ যা বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, কোষ এবং প্রোটিন এর সমন্বয়ে গঠিত। এবং যা আমাদের শরীরের কোষগুলোকে ব্যাকটেরিয়াল এবং ভাইরাল ইনফেকশন এর থেকে রক্ষা করে। যদি কোন কারনে এই ইমিউন সিস্টেম জীবাণু ধ্বংস করার বদলে আমাদের শরীরের সুস্থ কোষগুলিকে আক্রমন করে তখন তাকে বলা হয় অটোইমিউন রোগ। টাইপ-১ ডায়াবেটিস তখনই হয় যখন আমাদের ইমিউন সিস্টেম প্যাঙ্ক্রিয়াস এর বিটা কোষগুলিকে আক্রমন করে। অর্থাৎ এটা একটা অটো ইমিউন রোগ এবং এর ফলে টাইপ-১ ডায়াবেটিস হতে পারে।
৩) হরমোনের ভারসাম্যহীনতাঃ নারীদের গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা এক ধরনের হরমোন নিঃসরণ করে যা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স সৃষ্টি করতে পারে। তখন যদি প্যানক্রিয়াস পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদন করে এই ইনসুলিন রেসিস্ট্যান্স কে প্রতিহত করতে না পারে তখন জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস হতে পারে। এছাড়াও আরও কিছু হরমোন সংক্রান্ত জটিলতা যেমনঃ অ্যাক্রোমেগালি ( শরীরে গ্রোথ হরমোন স্বাভাবিক এর চেয়ে বেশি থাকা ) এবং কুশিং সিন্ড্রোম ( শরীরে করটিসল হরমোন স্বাভাবিক এর চেয়ে বেশি থাকা ) টাইপ-২ ডায়াবেটিসের সৃষ্টি করতে পারে।
৪) প্যানক্রিয়াস নষ্ট হয়ে যাওয়াঃ অনেক সময় আঘাতজনিত কারনে অথবা অপারেশন এর পর আমাদের প্যানক্রিয়াস এর উপর প্রভাব পরতে পারে যার ফলে প্যানক্রিয়াস পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে ব্যর্থ হয় এবং ডায়াবেটিস সৃষ্টি করে।
৫) বংশগতিঃ অনেক সময় মা বাবা কারও মধ্যে যদি ডায়াবেটিস থাকে তাহলে সেটা সন্তান এর মধ্যেও আসতে পারে।
বিস্তারিত জানুন: ডায়াবেটিস নিউরোপ্যাথি
ডায়াবেটিস নির্ণয় করার জন্য প্রয়োজন একটি গ্লুকোমিটার যার মধ্যে থাকা একটি সুই ব্যবহার করে আপনার হাতের আঙুল থেকে এক ফোঁটা রক্ত নিয়ে একটি বিশেষ স্ট্রিপের উপর রাখা হয় এবং আপনার রক্তের সুগারের লেভেল পরিমাপ করা হয়। সাধারনত ফাস্টিং অবস্থায় অথবা খালি পেটে আমাদের রক্তে সুগার এর স্বাভাবিক মাত্রা থাকা উচিত 99 mg/dl অথবা 5.5 mmol/L । যদি আপনার প্রি ডায়াবেটিস হয় তাহলে এই মাত্রা দাঁড়াবে 100mg/dl-125mg/dl অথবা 5.6 mmol/L-6.9 mmol/L. আর যদি আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন তাহলে এই মাত্রা হবে 126 mg/dl অথবা 7 mmol/L বা তার বেশি। আর নন ফাস্টিং অবস্থায় অথবা ভরা পেটে রক্তে সুগারের স্বাভাবিক মাত্রা হচ্ছে 140mg/dl অথবা 7.8 mmol/L বা এর কম। প্রি ডায়াবেটিস এর ক্ষেত্রে এই মাত্রা 140mg/dl-199mg/dl অথবা 7.8mmol/L-11 mmol/L. আর যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের এই মাত্রা টা দাঁড়াবে 200mg/dl বা 11.1 mmol/L বা তার বেশি।
এক্সারসাইজ কিভাবে আপনার ডায়াবেটিস ঝুঁকি কমায়
১) হাঁটলে স্কেলেটাল মাসলের কনট্রাকশনের বৃদ্ধি পায়, ফলে মাসলে রক্ত সরবরাহ বেড়ে যায় এবং প্লাজমা থেকে বেশি পরিমাণ গ্লুকোজ কোষে প্রবেশ করে । ফলে আপনার রক্তেও সুগারের পরিমান কমে যায় । আমাদের কোষগুলো এনার্জি পায় । শরীরের দুর্বলতা থাকে না ।
২) আমাদের পেটের ভিতরের মেদ বা চর্বি (Intra abdominal fat) টাই বেশি দায়ী ডায়াবেটিসের জন্য , কারণ এটা আমাদের ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্ট এর জন্য দায়ী। এক্সারসাইজের ফলে পেটের এই কালপ্রিট মেদ দ্রুত কমে যায়।
৩) মডারেন্ট ইনটেনসিটির এক্সারসাইজ করলে কোষের গ্লুকোজ গ্রহনের মাত্রা ৪০% বেড়ে যায়। যেমনঃ দ্রুত হাঁটা , সাইক্লিং করা ইত্যাদি।
অর্থাৎ সোজা কথা এক্সারসাইজ করলে ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বেড়ে যায় এবং কোষে গ্লুকোজের গ্রহনের মাত্রাও বেড়ে যায় । রক্তে সুগারের পরিমান কমে যায়।
হ্যাঁ, যদি ডায়াবেটিস থাকে তাহলে শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। এর ফলে শরীর থেকে বেশি পানি বেরিয়ে যায়, যা আপনাকে অতিরিক্ত পানির তৃষ্ণা দেয় এবং মুখ শুকিয়ে আসে।
ডায়াবেটিসের কারণে শরীর ঠিক মতো ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না, তাই ওজন হঠাৎ করে কমে যেতে পারে। এটি শরীরের শক্তি না পাওয়ার লক্ষণ হতে পারে।
ডায়াবেটিস থাকলে পায়ের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর ফলে পায়ের তলায় জ্বালা পোড়া বা অবশ লাগার মতো সমস্যাগুলো দেখা দেয়।
ডায়াবেটিস হলে শরীরের কোষে ঠিকমতো গ্লুকোজ পৌঁছাতে পারে না, তাই শরীর দুর্বল অনুভব করে এবং এনার্জি কম থাকে।
ডায়াবেটিস থাকলে শরীর গ্লুকোজের অতিরিক্ত মাত্রা প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করতে চেষ্টা করে। এর ফলে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজের কারণে চোখের লেন্সে সমস্যা হতে পারে, যা ঝাপসা দেখা দেওয়ার কারণ হতে পারে।
ডায়াবেটিস থাকলে ক্ষতগুলো সহজে সারতে চায় না, কারণ শরীরের রক্ত সঞ্চালন ঠিকমতো হয় না, যা সেরে ওঠার প্রক্রিয়া ধীর করে।
National Library of Medicine: Pathophysiology of Type 2 Diabetes Mellitus
International Diabetes Federation: Diabetes
American Diabetes Association: Diabetes
ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) এর মতে ২০২৩ সালে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে মারা গেছে । বর্তমানে প্রায় ৫৩ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগতেছে। প্রতি ১০ জনে ১ জন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ২০৪৫ সালে এটা ৭০ কোটিতে পৌছাবে।
২০১৯ সালে সারাবিশ্বে ডায়াবেটিস চিকিৎসার জন্য কমপক্ষে ৭২০ বিলিয়ন ডলার ( ৮৬ লক্ষ কোটি টাকা) ব্যয় হয়েছে।
বাংলাদেশে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা অনেক বেশি । বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১ কোট ৩২ লাখ ডায়াবেটিসের রোগী আছে (স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০২৩ তথ্য অনুযায়ী)। এছাড়া প্রায় সমপরিমান রোগী আছে যাদের ডায়াবেটিস আছে , কিন্তু তারা জানে না।
বিস্তারিত জানুন: ডায়াবেটিস জটিলতা
ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরনেরঃ
টাইপ – ১ ডায়াবেটিসঃ টাইপ -১ ডায়াবেটিসে আমাদের শরীর সাধারনত কোন ইনসুলিন উৎপাদনই করতে পারে না কিংবা শরীরের চাহিদা অনুযায়ী খুবই সামান্য ইনসুলিন উৎপাদন করে। এটা সাধারনত হয়ে থাকে যখন প্যানক্রিয়াসের ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায়। মূলত শরীরেরর অটোইমিউন সিস্টেম যখন ভালভাবে কাজ না করে তখন এমন হয়ে থাকে। যেহেতু শরীরে কোন ইনসুলিন উৎপাদন হচ্ছে না , ফলে আমরা যেই খাবার খাচ্ছি সেখান থেকে গ্লূকোজ আমাদের শরীরের কোষে প্রবেশ করতে পারছে না এবং আমাদের শরীরের কোষগুলো এনার্জি পাচ্ছে না। আমরা দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। এই গ্লূকোজ শরীরের কোষে প্রবেশ করার জন্য ইনসুলিন অত্যাবশ্যকীয়। আর এই কারনেই টাইপ -১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে বাহিরের থেকে শরীরে ইনসুলিন পুশ করতে হয়। মোট ডায়াবেটিসের ৫-৭% টাইপ ১ ডায়াবেটিস। টাইপ ১ ডায়াবেটিস বাহিরের থেকে ইনসুলিন নেওয়া ছাড়া নিয়ন্ত্রন সম্ভব নয়। তবে এক্সারসাইজ করলে অবশ্যই উপকৃত হওয়া যায়।
টাইপ – ২ ডায়াবেটিসঃ টাইপ – ২ ডায়াবেটিস হয় মূলত ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের জন্য।
বিস্তারিত জানুন: ডায়াবেটিস ফুট আলসার
ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হল আমাদের শরীরের এমন একটি অবস্থা , যেখানে প্যানক্রিয়াস ইনসুলিন উৎপাদন করে ঠিকই কিন্তু আমাদের শরীরের কোষগুলো উৎপাদিত ইনসুলিনকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে না।
ইনসুলিন কাজ না করার কারণে শরীরের কোষে গ্লূকোজ প্রবেশ করতে পারে না , যার ফলে রক্তে গ্লূকোজের মাত্রা বেড়ে যায় । কারণ এই ইনসুলিনের কাজই হল রক্ত থেকে গ্লূকোজকে শরীরের কোষে প্রবেশ করানো। শরীরের কোষগুলো এই গ্লূকোজকে শক্তি হিসেবে গ্রহন করে বেঁচে থাকে।
ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনে মতে ৯০% এর বেশি টাইপ-২ ডায়াবেটিস। কোন কোন গবেষনা অনুযায়ী ৯৫% এর বেশি টাইপ -২ ডায়াবেটিস।
নিয়মিত এক্সারসাইজ , জীবনযাত্রার পরিবর্তন , সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং আধুনিক কিছু থেরাপির মাধ্যমে টাইপ -২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রন করা যায়। অত্যাধুনিক কিছু থেরাপি – যেমনঃ ওজোন থেরাপি , আকুপাংচার থেরাপি , ম্যাগনেটিক এনার্জি থেরাপি এবং ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে ডায়াবেটিস পরবর্তী জটিলতা অনেকটাই কমানো সম্ভব।
এছাড়া আরোও কিছু ডায়াবেটিস আছে , যেমন – জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস , নিউনেটাল ডায়াবেটিস। জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস সাধারনত গর্ভবতী মায়েদের হয়ে থাকে। সন্তান প্রসবের পর এটা অটোমেটিক ভাল হয়ে যায়। তবে গ্যাস্ট্রেশনাল ডায়াবেটিস রোগীদের পরবর্তীতে টাইপ -২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ছোট বাচ্চাদের অনেক সময় ডায়াবেটিস থাকে এটাকে নিউনেটাল ডায়াবেটিস বলে। তবে এটা খুবই কম দেখা যায়।
বিস্তারিত জানুন: ডায়াবেটিস নিউরোপ্যাথি
আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি – ডায়াবেটিস মানেই আমাদের রক্তে গ্লুকোজের (সুগার) পরিমান নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেড়ে যাওয়া। এখন প্রশ্ন হল এই গ্লুকোজের
লেভেল কেন আমাদের রক্তে বেড়ে যায়।
১) ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সঃ আমাদের ডায়াবেটিসের ৯০% এর বেশি ডায়াবেটিস হল টাইপ ২ ডায়াবেটিস । এই টাইপ ২ ডায়াবেটিসের মূল কারণ হল ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স।
ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হল আমাদের শরীরের এমন একটি অবস্থা , যেখানে – প্যানক্রিয়াস ইনসুলিন উৎপাদন করে ঠিকই কিন্তু আমাদের শরীরের কোষগুলো ইনসুলিনকে ভালভাবে গ্রহন করতে পারে না । ভাল্ভাবে গ্রহন না করার কারণে ইনসুলিন রক্ত থেকে গ্লুকোজকে শরীরের কোষে প্রবেশ করাতে পারে না এবং টিস্যু গুলো তাদের প্রয়োজনীয় এনার্জি পায় না । টিস্যূতে গ্লুকোজ প্রবেশ না করার কারণে রক্তে গ্লুকোজের (সুগার) পরিমান বাড়তে থাকে , এটাই টাইপ -২ ডায়াবেটিস । এখন প্রশ্ন হল – ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কেন হয় –
শরীরের অতিরিক্ত চর্বিঃ আমাদের পেটের চর্বি , বিশেষ করে পেটের ভিতরের ভিসেরাল চর্বি ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের জন্য দায়ী । গবেষনায় দেখা গেছে – আমদের পেটের ভিতরের চর্বি আমাদের শরীরে এমন কিছু হরমোন এবং উপাদান তৈরি করে , যেইগুলো আমাদের শরীরের দীর্ঘমেয়াদী ইনফ্লামেশন (প্রদাহ) তৈরি করে । এই ইনফ্লামেশন থেকে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হয়ে থাকে ।
শারিরীক প্ররিশ্রম না করাঃ শারীরিক পরিশ্রম আমাদের শরীরে মাংসপেশির গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং ইনসুলিন কে শরীরের প্রতি আরও আগ্রহী করে তোলে। যার ফলে ইনসুলিন এই মাংসপেশির কোষগুলোতে প্রয়োজন অনুযায়ী গ্লুকোজ পাঠাতে সক্ষম হয় এবং আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় শক্তি পাই। অপরদিকে শারীরিক পরিশ্রম না করলে আমাদের শরিরে চর্বি জমতে শুরু করে, আমাদের ওজন বেড়ে যায় এবং শরীরে ইনসুলিন রেসিস্ট্যান্স সৃষ্টি হয়।
খাদ্যাভ্যাসঃ অনেক বেশি শর্করা জাতীয় খাবার, প্রসেসড ফুড এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাট খেলেও শরীরে ইনসুলিন রেসিস্ট্যান্স হতে পারে। কারন এসব খাবার আমাদের শরীরে খুব তাড়াতাড়ি হজম হয়ে যায় অথবা ভেঙ্গে যায়। এর ফলে শরীরে শুগার এর মাত্রা স্বাভাবিক এর থেকে অনেক বেশি বেড়ে যায়। এই কারনে আমাদের প্যাঙ্ক্রিয়াস গ্রন্থিকেও এই শুগার নিয়ন্ত্রন এর জন্য স্বাভাবিক এর চাইতে অনেক বেশি ইনসুলিন উৎপাদন করতে হয়। এর ফলে প্যাঙ্ক্রিয়াস এর উপর অতিরিক্ত চাপ পরে এবং এক সময় প্যাঙ্ক্রেয়াস ইনসুলিন রেসিস্ট্যান্স হয়ে পরে।
মেডিসিনঃ কিছু মেডিসিন যেমন- স্টেরয়েড, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন করার মেডিসিন, অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ ইত্যাদি দীর্ঘ সময় ধরে গ্রহন করলে রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক এর থেকে বেড়ে গিয়ে শরীরে ইনসুলিন রেসিস্ট্যান্স হতে পারে।
২) অটোইমিউন রোগঃ ইমিউন সিস্টেম হচ্ছে আমাদের শরীরের এমন একটি অংশ যা বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, কোষ এবং প্রোটিন এর সমন্বয়ে গঠিত। এবং যা আমাদের শরীরের কোষগুলোকে ব্যাকটেরিয়াল এবং ভাইরাল ইনফেকশন এর থেকে রক্ষা করে। যদি কোন কারনে এই ইমিউন সিস্টেম জীবাণু ধ্বংস করার বদলে আমাদের শরীরের সুস্থ কোষগুলিকে আক্রমন করে তখন তাকে বলা হয় অটোইমিউন রোগ। টাইপ-১ ডায়াবেটিস তখনই হয় যখন আমাদের ইমিউন সিস্টেম প্যাঙ্ক্রিয়াস এর বিটা কোষগুলিকে আক্রমন করে। অর্থাৎ এটা একটা অটো ইমিউন রোগ এবং এর ফলে টাইপ-১ ডায়াবেটিস হতে পারে।
৩) হরমোনের ভারসাম্যহীনতাঃ নারীদের গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা এক ধরনের হরমোন নিঃসরণ করে যা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স সৃষ্টি করতে পারে। তখন যদি প্যানক্রিয়াস পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদন করে এই ইনসুলিন রেসিস্ট্যান্স কে প্রতিহত করতে না পারে তখন জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস হতে পারে। এছাড়াও আরও কিছু হরমোন সংক্রান্ত জটিলতা যেমনঃ অ্যাক্রোমেগালি ( শরীরে গ্রোথ হরমোন স্বাভাবিক এর চেয়ে বেশি থাকা ) এবং কুশিং সিন্ড্রোম ( শরীরে করটিসল হরমোন স্বাভাবিক এর চেয়ে বেশি থাকা ) টাইপ-২ ডায়াবেটিসের সৃষ্টি করতে পারে।
৪) প্যানক্রিয়াস নষ্ট হয়ে যাওয়াঃ অনেক সময় আঘাতজনিত কারনে অথবা অপারেশন এর পর আমাদের প্যানক্রিয়াস এর উপর প্রভাব পরতে পারে যার ফলে প্যানক্রিয়াস পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে ব্যর্থ হয় এবং ডায়াবেটিস সৃষ্টি করে।
৫) বংশগতিঃ অনেক সময় মা বাবা কারও মধ্যে যদি ডায়াবেটিস থাকে তাহলে সেটা সন্তান এর মধ্যেও আসতে পারে।
বিস্তারিত জানুন: ডায়াবেটিস নিউরোপ্যাথি
ডায়াবেটিস নির্ণয় করার জন্য প্রয়োজন একটি গ্লুকোমিটার যার মধ্যে থাকা একটি সুই ব্যবহার করে আপনার হাতের আঙুল থেকে এক ফোঁটা রক্ত নিয়ে একটি বিশেষ স্ট্রিপের উপর রাখা হয় এবং আপনার রক্তের সুগারের লেভেল পরিমাপ করা হয়। সাধারনত ফাস্টিং অবস্থায় অথবা খালি পেটে আমাদের রক্তে সুগার এর স্বাভাবিক মাত্রা থাকা উচিত 99 mg/dl অথবা 5.5 mmol/L । যদি আপনার প্রি ডায়াবেটিস হয় তাহলে এই মাত্রা দাঁড়াবে 100mg/dl-125mg/dl অথবা 5.6 mmol/L-6.9 mmol/L. আর যদি আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন তাহলে এই মাত্রা হবে 126 mg/dl অথবা 7 mmol/L বা তার বেশি। আর নন ফাস্টিং অবস্থায় অথবা ভরা পেটে রক্তে সুগারের স্বাভাবিক মাত্রা হচ্ছে 140mg/dl অথবা 7.8 mmol/L বা এর কম। প্রি ডায়াবেটিস এর ক্ষেত্রে এই মাত্রা 140mg/dl-199mg/dl অথবা 7.8mmol/L-11 mmol/L. আর যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের এই মাত্রা টা দাঁড়াবে 200mg/dl বা 11.1 mmol/L বা তার বেশি।
১) হাঁটলে স্কেলেটাল মাসলের কনট্রাকশনের বৃদ্ধি পায়, ফলে মাসলে রক্ত সরবরাহ বেড়ে যায় এবং প্লাজমা থেকে বেশি পরিমাণ গ্লূকোজ কোষে প্রবেশ করে । ফলে আপনার রক্তেও সুগারের পরিমান কমে যায় । আমাদের কোষগুলো এনার্জি পায় । শরীরের দুর্বলতা থাকে না ।
২) আমাদের পেটের ভিতরের মেদ বা চর্বি (Intra abdominal fat) টাই বেশি দায়ী ডায়াবেটিসের জন্য , কারণ এটা আমাদের ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্ট এর জন্য দায়ী। এক্সারসাইজের ফলে পেটের এই কালপ্রিট মেদ দ্রুত কমে যায়।
৩) মডারেন্ট ইনটেনসিটির এক্সারসাইজ করলে কোষের গ্লূকোজ গ্রহনের মাত্রা ৪০% বেড়ে যায়। যেমনঃ দ্রুত হাঁটা , সাইক্লিং করা ইত্যাদি।
অর্থাৎ সোজা কথা এক্সারসাইজ করলে ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বেড়ে যায় এবং কোষে গ্লূকোজের গ্রহনের মাত্রাও বেড়ে যায় । রক্তে সুগারের পরিমান কমে যায়।
১। আপনার কি অতিরিক্ত পানির তৃষ্ণা পায় বা মুখ শুকিয়ে আসে ?
২। আপনার কি হঠাৎ করে ওজন কমে যাচ্ছে ?
৩। আপনার কি পায়ের তলায় জ্বালা পোড়া করে বা অবশ অবশ লাগে ?
৪। আপনার শরীর কি দুর্বল দুর্বল লাগে বা শরীরে কম এনার্জি পাচ্ছেন কি ?
৫। আপনার কি ঘন ঘন প্রস্রাব হয় ?
৬ । আপনি কি চোখে ঝাপসা ঝাপসা দেখেন ?
৭ । আপনার কোথাও কেটে গেলে সহজেই ভাল হচ্ছে না ?