আপনারা সবাই নিশ্চয়ই এই শিরোনামটি দেখে একটু অবাক হয়েছেন। ভরা পেটে ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল! এই ধরনের কথা অনেকেই শুনে থাকতে পারেন, হয়তো বন্ধু-বান্ধব থেকে, আবার হয়তো কোনো অবিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে। কিন্তু এই ধারণাটি কতটা সঠিক? আজকের এই ব্লগ পোস্টে আমরা এই ভুল ধারণাটি ভেঙে ফেলবো এবং ডায়াবেটিস সম্পর্কে কিছু সঠিক তথ্য জানবো।
ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল?
ডায়াবেটিস নিয়ে চিন্তা আমাদের অনেকের মধ্যেই থাকে, তাই এই বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা জরুরি। ডায়াবেটিস বলতে আমরা রক্তে শর্করার (সুগার) মাত্রা বেশি হয়ে যাওয়াকে বুঝি। কিন্তু কতটা সুগার থাকা স্বাভাবিক? সেটা নির্ভর করে আপনি কিভাবে পরীক্ষা করছেন।
গ্লুকোমিটারে ডায়াবেটিস মাপা
গ্লুকোমিটার এমন একটি যন্ত্র, যা দিয়ে আঙুলের রক্ত নিয়ে ব্লাড সুগার পরীক্ষা করা যায়। অনেকেই এটি বাড়িতে ব্যবহার করেন বা ফার্মেসিতে গিয়ে সুগার মাপেন। একজন সুস্থ মানুষের খাবার খাওয়ার আগে রক্তে সুগারের মাত্রা ৪ থেকে ৬ mmol/l এর মধ্যে থাকা উচিত। আর খাবার খাওয়ার ২ ঘণ্টা পরে সুগার ৮ mmol/l এর নিচে থাকলে তা স্বাভাবিক ধরা হয়।
ল্যাবে ডায়াবেটিস পরীক্ষা
হাসপাতালে বা ল্যাবে রক্তের শিরা থেকে নেওয়া রক্ত দিয়ে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা হয়। ল্যাবের পরীক্ষার ফলাফল গ্লুকোমিটারের তুলনায় একটু কম আসতে পারে, তবে উভয় ক্ষেত্রেই নিয়ম প্রায় একই থাকে।
খালি পেটে ডায়াবেটিস কত থাকা উচিত?
খালি পেটে, অর্থাৎ সকালবেলা খাবার খাওয়ার আগে যদি রক্তে সুগারের মাত্রা ৫.৫ পয়েন্টের আশেপাশে থাকে, তবে সেটি ভালো। কিন্তু যদি এটি ৬.১ থেকে ৬.৯ পয়েন্টের মধ্যে থাকে, তখন তাকে প্রি-ডায়াবেটিস বলা হয়। এই অবস্থাকে “সতর্ক সংকেত” হিসেবে ধরা হয়। এর মানে, আপনার টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি আছে এবং দ্রুতই জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনা দরকার।
ভরা পেটে ডায়াবেটিস কত থাকে?
খাওয়ার পরে রক্তে সুগারের মাত্রা স্বাভাবিকভাবেই একটু বেড়ে যায়। কিন্তু সেটি ৭.৮ পয়েন্টের নিচে থাকলে তা স্বাভাবিক ধরা হয়। যদি এটি ৭.৮ পয়েন্ট ছাড়িয়ে যায়, তাহলে প্রি-ডায়াবেটিস বলে ধরা হয়। আর ১১.১ পয়েন্টের বেশি হলে সেটি ডায়াবেটিসের লক্ষণ হতে পারে। এই অবস্থায় অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা শুরু করা জরুরি।
ডায়াবেটিসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সময়মতো নিয়ন্ত্রণ করা না হলে হৃদরোগসহ অন্যান্য নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। তবে, যদি সতর্কতা অবলম্বন করা হয় এবং জীবনধারায় পরিবর্তন আনা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। ছোট ছোট অভ্যাসের পরিবর্তন, যেমন: নিয়মিত হাঁটা, পরিমিত খাবার খাওয়া, এবং নিয়মিত ব্লাড সুগার পরীক্ষা করা এসব আমাদের সুস্থ রাখার অন্যতম উপায়।
ভরা পেটে ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল
খাবার খাওয়ার পর আমাদের রক্তে শর্করার মাত্রা কিছুটা বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। কারণ, শরীর খাবার থেকে গ্লুকোজ গ্রহণ করে এবং সেই গ্লুকোজ রক্তের মাধ্যমে বিভিন্ন কোষে পৌঁছে দেয়। এই প্রক্রিয়ায় রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ে। তবে, রক্তে শর্করার মাত্রা কতটা বাড়ছে, তা দেখে বোঝা যায় আমাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা কেমন। বিশেষত, এই মাত্রা খুব বেশি বেড়ে গেলে ডায়াবেটিস বা প্রি-ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থাকে।
খাবার খাওয়ার পরে রক্তে শর্করার মাত্রা ৭.৮ mmol/L এর নিচে থাকা উচিত। যদি শর্করার পরিমাণ ৭.৮ mmol/L এর বেশি হয়, তাহলে সেটাকে প্রি-ডায়াবেটিস বলা হয়, যা ডায়াবেটিসের শুরুর ধাপ। যদি রক্তে শর্করার মাত্রা ১১.১ mmol/L এর বেশি হয়, তাহলে এটা ডায়াবেটিস হতে পারে। এমন অবস্থায় দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া এবং চিকিৎসা শুরু করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে শরীরের উপর বেশি চাপ না পড়ে।
বয়স অনুযায়ী রক্তের শর্করার স্বাভাবিক মাত্রা
বয়সের উপর ভিত্তি করে রক্তে শর্করার স্বাভাবিক স্তর পরিবর্তিত হতে পারে। এখানে বয়সভেদে স্বাভাবিক রক্তের শর্করার মাত্রা দেওয়া হলো:
- ৫০ বছরের কম বয়সী ব্যক্তিদের জন্য: খাবারের পরে 100-140 mg/dL রক্তে শর্করার স্বাভাবিক ধরা হয়।
- ৫০-৫৯ বছর বয়সের মানুষের জন্য: রক্তে শর্করার স্বাভাবিক মাত্রা ১০০ থেকে ১৫০ mg/dL এর মধ্যে থাকা উচিত।
- ৬০-৬৯ বছর বয়সের মধ্যে: 110-160 mg/dL রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়।
- ৭০ বছরের বা তার বেশি বয়সের মানুষের জন্য: রক্তে শর্করার মাত্রা ১২০ থেকে ১৭০ mg/dL এর মধ্যে থাকা উচিত।
ডায়াবেটিসের ধরন অনুযায়ী রক্তের শর্করার স্বাভাবিক মাত্রা
ডায়াবেটিসের ধরণ অনুযায়ী রক্তে শর্করার মাত্রাও ভিন্ন হতে পারে। টাইপ ১ এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসে স্বাভাবিক রক্তের শর্করার মাত্রা আলাদা হতে পারে।
টাইপ ১ ডায়াবেটিসে যারা ভুগছেন, তাদের খাবার খাওয়ার পর রক্তে শর্করার মাত্রা ৭০ থেকে ১৩০ mg/dL এর মধ্যে থাকা উচিত।
অন্যদিকে, টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে খাবার খাওয়ার পর রক্তে শর্করার মাত্রা ৯০ থেকে ১৫০ mg/dL এর মধ্যে থাকলে তা স্বাভাবিক ধরা হয়।
গর্ভবতী নারীদের জন্য
গর্ভাবস্থায় শরীরে শর্করার মাত্রা একটু আলাদা হতে পারে। খাবার খাওয়ার পর গর্ভবতী মায়েদের রক্তে শর্করা ৯০-১২০ mg/dL এর মধ্যে থাকাই ভালো। এতে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে, আর মা ও শিশু দুজনেই সুস্থ থাকে।
কী কী বিষয় রক্তে শর্করার মাত্রা প্রভাবিত করতে পারে?
খাবারের পরে রক্তে শর্করার মাত্রা শুধু খাবারের ধরণ এবং পরিমাণের উপরই নির্ভর করে না, বরং আপনার শারীরিক কার্যকলাপ, ঔষধ গ্রহণ, এবং স্বাস্থ্য অবস্থার উপরও নির্ভর করে। যদি আপনি নিয়মিত শরীরচর্চা করেন, তবে আপনার শরীর দ্রুত গ্লুকোজ ব্যবহার করতে সক্ষম হয়, যার ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রিত থাকে। একইভাবে, ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য নেওয়া ঔষধগুলিও রক্তে শর্করার মাত্রার উপর প্রভাব ফেলে।
কেন রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করা জরুরি?
আপনার রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যদি আপনার ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থাকে। আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের (ADA) মতে, খাবার খাওয়ার পর দুই ঘন্টার মধ্যে রক্তে শর্করার মাত্রা ১৪০ mg/dL এর নিচে থাকা উচিত। রক্তের শর্করার এই মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে সেটা অস্বাভাবিক হিসেবে ধরা হয়।
আপনার স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিন
যদি আপনার ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থাকে বা ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, তবে সুস্থ থাকার জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, এবং সময়মতো ঔষধ গ্রহণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিস্তারিত জানুন: কোন ফল খেলে ডায়াবেটিস কমে? রোগীরা কোন ফল খাবেন না জেনে নিন!
বিস্তারিত জানুন: ডায়াবেটিস ফুট আলসার
বিস্তারিত জানুন: পুরুষের ডায়াবেটিস হলে কি সন্তান হয়? শুক্রানু কাউন্ট কত?
তথ্য সূত্র
Healthline — Normal Glucose Levels After Eating
Aga Matrix — Blood Sugar Levels: What is Normal, Low or High, Target Ranges & More [w/ Downloadable Chart]
Medline Plus — Managing your blood sugar
WebMD — How Sugar Affects Diabetes
Health Link BC — Diabetes: Blood Sugar Levels
Medical News Today — Fasting blood sugar (glucose): Normal levels and testing
সাধারণ জিজ্ঞাসা
কাঁঠাল খেলে কি ডায়াবেটিস বাড়ে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাঁঠালের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স প্রায় ৫০-৬০, যা মাঝারি মাত্রার। কাঁঠালে অনেক ফাইবার থাকে, যা রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়তে দেয় না।
প্রাকৃতিক উপায়ে ব্লাড সুগার কমানোর উপায়?
শাকসবজি খেলে বেশি ফাইবার পাওয়া যায়। কার্বোহাইড্রেট খাওয়ার সময়, এমন খাবার বেছে নিন যাতে বেশি ফাইবার থাকে, যা খাবারের পর রক্তে শর্করা ধীরে বাড়তে সাহায্য করে। পুরো গমের রুটি, ওটমিল, মটরশুটি, মসুর ডাল, বাদাম, বীজ এবং বাদামী চাল এই ধরনের ভালো খাবার।
ডায়াবেটিস হলে কি কি খাবার এড়ানো উচিত?
আপনি মিষ্টি, স্যাচুরেটেড ফ্যাট, এবং মাংস থেকে প্রোটিন খাওয়া এড়িয়ে চলতে পারেন। এই ধরনের ডায়েট অনেকের জন্য কঠিন হতে পারে, কারণ এতে খুব কম চর্বি থাকে (মাত্র ১০% ক্যালোরি)। তবে আপনি চাইলে একটু নমনীয়ভাবে খাবারের পরিকল্পনা করতে পারেন।
খাওয়ার পর কি সুগার ২৩০ বেশি হয়?
খাওয়ার পর রক্তে শর্করার মাত্রা কিছুটা বাড়তে পারে। তবে, খাওয়ার দুই ঘণ্টা পরে যদি শর্করার পরিমাণ ২০০ mg/dL এর বেশি হয়, তাহলে তা উচ্চ শর্করার (হাইপারগ্লাইসেমিয়া) নির্দেশ করে। যদি শর্করার মাত্রা প্রায় ২৩০ mg/dL হয়, তাহলে এটি উদ্বেগজনক এবং নিয়মিত পরীক্ষা ও চিকিৎসার প্রয়োজন।