কি খেলে ডায়াবেটিস দ্রুত কমে?
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সঠিক খাবার বেছে নেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে ভাবেন ডায়াবেটিস থাকলে পেটভরে খাওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু সেটা সত্যি নয়। সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুললে পেট ভরে খেয়েও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। চলুন, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এমন কিছু খাবার সম্পর্কে জেনে নেই –
কাঁচা বা সেদ্ধ করা সবজি
ডায়াবেটিস রোগীদের প্রচুর সবজি খাওয়া উচিত। আলু বা মিষ্টি জাতীয় সবজি এড়িয়ে চলাই ভালো। তবে টমেটো, শসা, বেগুন, মাশরুম, এবং সবুজ সবজি খাওয়া নিরাপদ। এই সবজিগুলো কাঁচা বা সেদ্ধ খেতে পারেন। ওভেন থাকলে রোস্টও করতে পারেন। সবজি দিয়ে ভর্তাও করতে পারেন, যা পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু হবে।
ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবার
আঁশযুক্ত খাবার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। বাদাম, মটরশুঁটি, ভুট্টা, শাক-সবজিতে প্রচুর ফাইবার থাকে। এগুলো শরীরকে দীর্ঘ সময় তৃপ্ত রাখে। মিষ্টি আলুও ফাইবারে ভরপুর এবং ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী।
চিনি ছাড়া চা
চা, বিশেষ করে ব্ল্যাক টি বা গ্রিন টি, ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ভালো। চিনি ছাড়া চা খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন, এতে শরীর থাকবে সতেজ এবং সুস্থ।
সামান্য চর্বি খেতে পারেন
ডায়াবেটিস রোগীদের চর্বি একেবারে বাদ দিতে হবে, এমন নয়। তবে অতিরিক্ত তেল বা চর্বি এড়িয়ে লিন মিট (যেমন মুরগির মাংস) বা অলিভ অয়েলে তৈরি খাবার খাওয়া যেতে পারে। এতে শরীর ভালো থাকবে।
প্রোটিনের অভাব নেই
ডায়াবেটিস রোগীরা প্রোটিন খেতে পারেন, তবে লাল মাংস (যেমন গরুর মাংস) এড়িয়ে চলা ভালো। মুরগি, কোয়েল বা কবুতরের মাংস প্রোটিনের ভালো উৎস হতে পারে। বাদামও প্রোটিনের চমৎকার উৎস।
শরবত খেতে ইচ্ছে করলে
ডায়াবেটিস রোগীরাও মাঝে মাঝে শরবত খেতে পারেন, তবে এতে চিনি মেশানো যাবে না। লেবুর শরবত বা বাঙ্গির শরবত পান করতে পারেন, যা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
দ্রুত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার উপায়
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কিছু সহজ পদক্ষেপ মেনে চলা খুবই জরুরি। এটি শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যই নয়, ছোটদের ক্ষেত্রেও এটি মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যখন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের কথা বলি, তখন জীবনধারায় কিছু পরিবর্তন আনাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আসুন দেখি, কীভাবে আপনি সহজেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
১. নিয়মিত ব্লাড সুগার চেক করুন
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো নিয়মিত ব্লাড সুগার পরীক্ষা করা। আপনার ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতি মাসে বা তিন মাস পরপর রক্তে শর্করা পরীক্ষা করা উচিত। নিয়মিত পরীক্ষা করলে আপনি জানতে পারবেন রক্তে শর্করার মাত্রা ঠিক আছে কিনা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবেন। এটি আপনার চিকিৎসা পরিকল্পনা ঠিক করতে সাহায্য করবে।
২. পুষ্টিকর এবং সুষম খাবার খান
সঠিক এবং পুষ্টিকর খাবার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেকের ধারণা থাকে যে, ডায়াবেটিস রোগীদের খাওয়ার ওপর অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে এবং তারা প্রায় কিছুই খেতে পারবে না। তবে এটি ভুল। সঠিক খাদ্যাভ্যাস তৈরি করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
আপনার খাবারের তালিকায় প্রচুর শাকসবজি, লাল চাল, ভুট্টা, বাদাম এবং ফলমূল রাখতে হবে। আলু, মিষ্টি জাতীয় খাবার এবং অতিরিক্ত মিষ্টি পানীয় পরিহার করুন। প্রতিদিন অল্প পরিমাণে বারবার খেলে শরীরের গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক থাকে। অনেক সময় দেখা গেছে, অল্প করে কিন্তু বারবার খাবার খেলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং কোলেস্টেরলের মাত্রাও সঠিক থাকে।
৩. নিয়মিত ব্যায়াম করুন
নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে অনেক উপকারী। প্রতিদিন ৩০ মিনিট ব্যায়াম করলে শরীরের ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা বাড়ে, রক্তে শর্করার মাত্রা কম থাকে এবং ওজনও নিয়ন্ত্রণে থাকে। হাঁটা, সাইকেল চালানো বা সাঁতার কাটা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বেশ কার্যকর। এছাড়াও যোগ ব্যায়াম ও ধ্যান মানসিক চাপ কমায় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
ব্যায়াম শুধুমাত্র শারীরিকভাবে সুস্থ রাখে না, এটি মানসিকভাবে আমাদের ভালো রাখে। যখন আমরা নিয়মিত ব্যায়াম করি, তখন স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা কমে এবং আমরা বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
৪. কার্বোহাইড্রেট বেছে খাওয়া
কার্বোহাইড্রেট খাবারের সাথে রক্তে শর্করার মাত্রা সরাসরি সম্পর্কিত। তাই সঠিকভাবে কার্বোহাইড্রেট বেছে খাওয়া প্রয়োজন। কার্বোহাইড্রেটের মধ্যে দুটি ধরন রয়েছে: সাধারণ কার্বোহাইড্রেট এবং জটিল কার্বোহাইড্রেট। সাধারণ কার্বোহাইড্রেট, যেমন সাদা চাল, চিনি, রুটি দ্রুত রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায়। অন্যদিকে, জটিল কার্বোহাইড্রেট, যেমন লাল চাল, গম, শাকসবজি ধীরে ধীরে রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায় এবং শরীরকে দীর্ঘ সময় ধরে শক্তি দেয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে জটিল কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার বেছে খাওয়া উচিত।
৫. পর্যাপ্ত পানি পান করুন
প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শরীরের অতিরিক্ত গ্লুকোজ প্রস্রাবের মাধ্যমে বের হয় এবং এটি শুধু রক্তে শর্করার মাত্রা ঠিক রাখে না, শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টিও বজায় রাখে। প্রতিদিন কমপক্ষে আট গ্লাস পানি পান করা উচিত। এছাড়া পানি শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে, যা সার্বিক সুস্থতার জন্য জরুরি।
৬. ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। অতিরিক্ত ওজন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। নিয়মিত ব্যায়াম এবং সুষম খাবারের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সামান্য ওজন কমানোর মাধ্যমেও রক্তে শর্করার মাত্রা ও ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ে। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৭. মানসিক চাপ এড়িয়ে চলুন
মানসিক চাপও ডায়াবেটিসের একটি বড় কারণ হতে পারে। যখন আমরা মানসিকভাবে চাপ অনুভব করি, তখন শরীর থেকে স্ট্রেস হরমোন নিঃসৃত হয় যা রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাই মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকা জরুরি। যোগ ব্যায়াম, ধ্যান এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া, কর্মজীবনের ভারসাম্য রক্ষা করা এবং প্রিয় কাজগুলো করা মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক হতে পারে।
৮. সঠিকভাবে ওষুধ গ্রহণ করুন
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে অনেক সময় ওষুধ প্রয়োজন হতে পারে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়া উচিত নয়। নিয়মিত ওষুধ সঠিকভাবে গ্রহণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার ডাক্তারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন এবং ওষুধের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে তাকে জানান।
৯. পর্যাপ্ত ঘুম
প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুম ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন ৭-৯ ঘণ্টা ঘুমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। ঘুমের অভাবে শরীরের শর্করার মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। পর্যাপ্ত ঘুম শরীরকে ঠিকমতো কাজ করতে অনেক সাহায্য করে থাকে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
১০. সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন
ডায়াবেটিস রোগীদের সুষম খাবার খাওয়া জরুরি। সবজি, ফল, লাল চাল এবং শর্করার কম খাবার বেছে নিন। প্রসেসড খাবার এবং কোমল পানীয় পরিহার করুন। আঁশযুক্ত খাবার যেমন শাকসবজি, লাল আটা এবং ঢেঁকিছাঁটা চালের মতো শস্য খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
১১. ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন করুন
ধূমপান এবং অ্যালকোহল ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এগুলো শুধু ডায়াবেটিসই নয়, শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেরও ক্ষতি করে। তাই এগুলো পরিহার করা উচিত।
১২. ডাক্তারকে নিয়মিত দেখান
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী জীবনধারায় পরিবর্তন আনলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে জীবনধারায় পরিবর্তন আনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খাবার, ব্যায়াম, পর্যাপ্ত পানি পান এবং মানসিক চাপ মুক্ত থাকা এগুলো মেনে চললে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। নিয়মিত রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করা, ডাক্তারের পরামর্শ মেনে ওষুধ খাওয়া এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করলে ডায়াবেটিস মোকাবেলা করা সম্ভব।
বিস্তারিত জানুন: ডায়াবেটিসে ঢেঁড়স এর উপকারিতা, গুনাগুন ও বৈজ্ঞানিক নাম কি?
বিস্তারিত জানুন: ডায়াবেটিস হলে কি কি সমস্যা হয়? এটি হলে কি লক্ষণ দেখা যায়?
বিস্তারিত জানুন: জবা ফুলের উপকারিতা ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ও রস খেলে কি হয়?
তথ্যসূত্র
WHO – Diabetes
NHS – Diabetes Prevention Programme (NHS DPP)
John Muir Health – Preventing Diabetes
সাধারণ জিজ্ঞাসা
ডায়াবেটিস কমে গেলে কি কি লক্ষণ দেখা দেয়?
ডায়াবেটিস কমে গেলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়মিতভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে। এর ফলে অতিরিক্ত প্রস্রাব, তীব্র তৃষ্ণা, ক্লান্তি, এবং ওজন কমার মতো উপসর্গগুলো হ্রাস পায়। এছাড়া শরীরে শক্তি ফিরে আসে এবং সামগ্রিকভাবে সুস্থতা অনুভূত হয়।
সুগার কত বছর বয়সে হয়?
ডায়াবেটিস (সুগার) যেকোনো বয়সে হতে পারে, তবে সাধারণত টাইপ ১ ডায়াবেটিস শিশু বা কিশোর বয়সে দেখা দেয়, আর টাইপ ২ ডায়াবেটিস প্রায়ই ৪০ বছর বা এর পরের বয়সে বেশি দেখা যায়। তবে, বর্তমানে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার কারণে কম বয়সেও টাইপ ২ ডায়াবেটিস দেখা যাচ্ছে।
কিভাবে ডায়াবেটিস ভালো করা যায়?
ডায়াবেটিস পুরোপুরি ভালো করা সম্ভব নয়, তবে নিয়মিত ব্লাড সুগার পরীক্ষা, সুষম খাবার, নিয়মিত ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে এটি সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং মানসিক চাপ কমিয়ে রাখাও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
ডায়াবেটিস না হওয়ার জন্য কি করতে হবে?
ডায়াবেটিস প্রতিরোধের জন্য স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন অপরিহার্য। সুষম খাবার খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা এবং মানসিক চাপ কমিয়ে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া প্রসেস করা খাবার ও অতিরিক্ত চিনি এড়িয়ে চলা ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সহায়ক।
নরমাল ডায়াবেটিস কত?
খালি পেটে (৮ ঘণ্টা না খেয়ে) স্বাভাবিক রক্তে শর্করার মাত্রা ৭০-৯৯ mg/dL এর মধ্যে হওয়া উচিত। খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর রক্তে শর্করার স্বাভাবিক মাত্রা ১৪০ mg/dL বা এর কম থাকা উচিত। এর থেকে বেশি হলে ডায়াবেটিস বা প্রিডায়াবেটিসের ঝুঁকি থাকতে পারে।