ডায়াবেটিস হলে কি কি সমস্যা হয়?
ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ, যা শরীরে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা তৈরি করতে পারে। এটি যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। ডায়াবেটিসের কারণে শরীরের নানা অংশে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। নিচে ডায়াবেটিস বেশি হলে কি কি সমস্যা হয়? সমস্যাগুলো নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।
১. চোখের সমস্যা (ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি)
ডায়াবেটিসের কারণে সবচেয়ে সাধারণ এবং বিপজ্জনক সমস্যাগুলোর একটি হলো চোখের রেটিনার ক্ষতি। এই সমস্যা “ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি” নামে পরিচিত। রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি হলে চোখের পিছনের রক্তনালিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা দৃষ্টিশক্তি কমিয়ে দেয়।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি প্রথম দিকে তেমন লক্ষণ প্রকাশ করে না, তবে সময়ের সাথে সাথে এটি দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত করতে শুরু করে। যদি এটি চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে অন্ধত্বের কারণ হতে পারে। এছাড়াও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ছানি (ক্যাটারেক্ট) এবং গ্লুকোমার ঝুঁকি বেশি থাকে। ছানি হলো চোখের স্বচ্ছ লেন্সের মেঘলা হয়ে যাওয়া, যা বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবে ঘটে, কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া তাড়াতাড়ি শুরু হতে পারে।
গ্লুকোমা হলো চোখের অপটিক স্নায়ুর ক্ষতি, যা চোখের অভ্যন্তরে অতিরিক্ত চাপের কারণে হয়। ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে গ্লুকোমা হওয়ার ঝুঁকি সাধারণ মানুষের চেয়ে দ্বিগুণ। এ কারণে চোখের নিয়মিত পরীক্ষা করা এবং প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা গ্রহণ করা জরুরি।
২. পায়ের সমস্যা (ডায়াবেটিক ফুট)
ডায়াবেটিসের আরেকটি গুরুতর সমস্যা হলো পায়ের সমস্যা, যা “ডায়াবেটিক ফুট” নামে পরিচিত। ডায়াবেটিসের কারণে স্নায়ু এবং রক্তনালিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে পায়ের অনুভূতি কমে যায়। এর ফলে, ছোট খাটো কাটা-ছেঁড়া বা ফোসকা পড়লেও তা দ্রুত সারতে চায় না, বরং সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।
স্নায়ুর ক্ষতি (নিউরোপ্যাথি) হলে পায়ে যন্ত্রণা, ঝিনঝিনে ভাব বা অসাড়তা দেখা দিতে পারে। পায়ে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হলে তা সংক্রমণ এবং গ্যাংগ্রিনের কারণ হতে পারে, যার ফলে অঙ্গচ্ছেদ পর্যন্ত করতে হতে পারে। ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের পায়ের স্বাস্থ্য খুবই সতর্কতার সাথে দেখা উচিত এবং কোনো পরিবর্তন লক্ষ করলে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
৩. হৃদরোগ এবং স্ট্রোক
ডায়াবেটিস রক্তনালিগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং এটি হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক কাজকর্মে বাধা দেয়। ফলে হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। রক্তে অতিরিক্ত শর্করা জমা হলে রক্তনালিগুলোর দেয়ালে প্ল্যাক জমতে শুরু করে, যা রক্ত সঞ্চালনকে বাধাগ্রস্ত করে। এর ফলে হৃদযন্ত্রে অক্সিজেন এবং পুষ্টির সরবরাহ ঠিকমতো না পৌঁছালে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
স্ট্রোকও ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য একটি বড় ঝুঁকি। যখন মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়, তখন স্ট্রোক ঘটে। ডায়াবেটিস আক্রান্তদের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি থাকে, কারণ তাদের রক্তনালিগুলো ইতোমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।
৪. কিডনির সমস্যা (ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি)
ডায়াবেটিস দীর্ঘ সময় ধরে নিয়ন্ত্রণে না থাকলে কিডনির কার্যক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা “ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি” নামে পরিচিত। কিডনি শরীর থেকে বর্জ্য এবং অতিরিক্ত তরল বের করতে সাহায্য করে, কিন্তু ডায়াবেটিসের কারণে এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। রক্তে অতিরিক্ত শর্করা কিডনির ক্ষুদ্র রক্তনালিগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, ফলে কিডনি ঠিকমতো কাজ করতে পারে না।
কিডনি সমস্যার লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়, যেমন পায়ে ফোলাভাব, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং ক্লান্তি। সময়মতো চিকিৎসা না করলে এই সমস্যা কিডনি ফেইলিওর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, যার ফলে ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হতে পারে।
৫. স্নায়ুর সমস্যা (ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি)
ডায়াবেটিসের কারণে রক্তে অতিরিক্ত শর্করা স্নায়ুগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা “ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি” নামে পরিচিত। এর ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশে অনুভূতি হ্রাস পায়, বিশেষ করে হাত-পায়ে। নিউরোপ্যাথির কারণে পায়ে বা হাতে যন্ত্রণা, ঝিনঝিনে ভাব বা পেশিতে দুর্বলতা দেখা দেয়।
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পায়ে হয় এবং এটি গুরুতর হলে হাঁটাচলা করতে সমস্যা হতে পারে। এছাড়া স্নায়ুর ক্ষতির কারণে হজমের সমস্যাও দেখা দিতে পারে, যেমন পেট ফাঁপা, কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া।
৬. যৌন সমস্যা
ডায়াবেটিসের কারণে পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের মধ্যেই যৌন সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। পুরুষদের ক্ষেত্রে ইরেক্টাইল ডিসফাংশন (যৌন উত্তেজনা কমে যাওয়া) হতে পারে, কারণ রক্তে উচ্চ শর্করা যৌন অঙ্গে প্রবাহিত রক্তের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। মহিলাদের মধ্যে যৌন অঙ্গে সংবেদনশীলতা কমে যেতে পারে এবং তাদেরও যৌন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে, যার ফলে মহিলাদের মধ্যে মূত্রনালির সংক্রমণ বা থ্রাশ হতে পারে।
৭. মাড়ি এবং দাঁতের সমস্যা
রক্তে বেশি শর্করা থাকলে মুখের লালায়ও এর পরিমাণ বেড়ে যায়, যা ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো দাঁত এবং মাড়ির ওপর প্রভাব ফেলে এবং অ্যাসিড তৈরি করে, যা দাঁতের এনামেল ক্ষয় করে। এর ফলে দাঁতের ক্ষয় এবং মাড়ির রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। মাড়ির ইনফেকশন, মাড়ি থেকে রক্তপাত এবং দাঁতের সমস্যা ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে সাধারণভাবে দেখা যায়।
৮. অন্যান্য ঝুঁকি
ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের কিছু নির্দিষ্ট ধরনের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে, যেমন কোলন ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার এবং অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার। এছাড়াও ডায়াবেটিস রোগীদের কিছু চিকিৎসা প্রক্রিয়া, যেমন কেমোথেরাপি, তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন করে তুলতে পারে।
৯. মানসিক সমস্যা
ডায়াবেটিসের কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব পড়তে পারে। ক্রমাগত শারীরিক জটিলতা এবং রক্তশর্করা নিয়ন্ত্রণের চিন্তা মানসিক চাপে পরিণত হতে পারে। অনেক ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে হতাশা এবং উদ্বেগ দেখা দেয়, যা তাদের শারীরিক অবস্থাকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
ডায়াবেটিস হলে কি কি লক্ষণ দেখা যায়?
ডায়াবেটিস হলে শরীরে কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ দেখা দিতে পারে যা সঠিক সময়ে জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষণগুলো সহজে বোঝার জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো খেয়াল করতে হবে:
- ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া এবং খুব পিপাসা লাগা, এমনকি পর্যাপ্ত পানি পান করার পরেও বারবার পানি পিপাসা লাগে।
- শরীর দুর্বল ও ক্লান্ত লাগা, অনেক সময় ঘোর ঘোর ভাব আসে, কাজ করতে ইচ্ছা করে না।
- ক্ষুধা অনেক বেড়ে যাওয়া, বারবার খেতে ইচ্ছা করা, বিশেষ করে মিষ্টি জাতীয় খাবারের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যাওয়া।
- কোন কারণ ছাড়াই ওজন কমতে থাকা, যদিও খাবারের পরিমাণ পরিবর্তন করা হয়নি।
- শরীরে কোনও ক্ষত বা কাটাছেঁড়া হলে তা খুব ধীরে শুকায়, অনেক দিন পার হলেও পুরোপুরি সেরে না ওঠা।
- ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া, খসখসে লাগা এবং ত্বকে চুলকানি হওয়া, যা স্বাভাবিক ত্বকের চেয়ে ভিন্নভাবে দেখা দেয়।
- বিরক্তি বা মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, সামান্য বিষয়েও ধৈর্য্য হারানো।
- চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা, যা নিয়মিত হয় এবং স্বাভাবিক চোখের অবস্থায়ও কম দেখতে শুরু করা।
- হাত বা পায়ে স্পর্শ এবং ব্যথার অনুভূতি কমে যাওয়া, যেন সেসব জায়গায় অনুভূতি হারিয়ে ফেলছে।
- শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, যার ফলে সংক্রমণের প্রবণতা বেড়ে যায় এবং সামান্য অসুস্থতাও দীর্ঘস্থায়ী হতে থাকে।
ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায় এমন কিছু কারণও রয়েছে, যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি:
- পরিবারের কারো ডায়াবেটিস থাকলে, বিশেষ করে নিকট আত্মীয়দের মধ্যে কেউ টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে।
- অতিরিক্ত ওজন বা মোটা হলে, শরীরের ওজন বেড়ে গেলে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
- শারীরিক পরিশ্রম কম করা বা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন করা, যেমন এক জায়গায় বসে বেশির ভাগ সময় কাটানো।
- প্রি-ডায়াবেটিস থাকলে, অর্থাৎ রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে, কিন্তু ডায়াবেটিসের নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কম হলে।
- পূর্বে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলে, গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হলে পরবর্তী জীবনে টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
- তামাকজাত দ্রব্য গ্রহণ করলে, যেমন ধূমপান বা অন্য কোনও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করলে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- খাদ্যতালিকায় অতিরিক্ত চিনি এবং কম ফাইবারযুক্ত খাবার থাকলে, যেমন মিষ্টি বা উচ্চ চিনি যুক্ত খাবার বেশি খাওয়া।
- অতিরিক্ত মানসিক চাপ থাকলে, দীর্ঘদিন মানসিক চাপ থাকলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং এই লক্ষণগুলোর কোনোটি দেখা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
বিস্তারিত জানুন: কি খেলে ডায়াবেটিস দ্রুত কমে? দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করার উপায়
বিস্তারিত জানুন: ডায়াবেটিসে ঢেঁড়স এর উপকারিতা, গুনাগুন ও বৈজ্ঞানিক নাম কি?
বিস্তারিত জানুন: জবা ফুলের উপকারিতা ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ও রস খেলে কি হয়?
তথ্যসূত্র
Diabetes UK – Complications of diabetes
Mayo Clinic – Diabetes
Medline Plus – Diabetes Complications
Cleveland Clinic – Diabetes
WebMD – How Does Diabetes Affect Your Body?
সাধারণ জিজ্ঞাসা
নিম পাতার রস খেলে কি সুগার কমে?
নিম পাতার রস খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক। এতে রয়েছে অ্যান্টিডায়াবেটিক উপাদান, যা ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়াতে এবং শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
কাঁঠাল খেলে কি ডায়াবেটিস বাড়ে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাঁঠালের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৫০ থেকে ৬০ এর মধ্যে, যা মাঝারি পর্যায়ে পড়ে। কাঁঠালে অনেক ফাইবার থাকে, যা রক্তে চিনি দ্রুত বাড়তে দেয় না।