ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ যা শরীরের রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি করে। এই রোগটি দীর্ঘদিন ধরে থাকলে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করে। এর মধ্যে একটি হল ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি। এই রোগটিতে ডায়াবেটিসের কারণে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। আজকের এই ব্লগ পোস্টে আমরা ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি এর লক্ষণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো, কোন ধরনের ঔষধ ব্যবহার করা হয় এবং এর চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে জানব।
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি কি?
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি এক ধরনের স্নায়ুর ক্ষতি, যা ডায়াবেটিসের কারণে ঘটে। প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি ডায়াবেটিস রোগী এই দীর্ঘস্থায়ী জটিলতায় ভোগেন। বিশেষ করে, যাদের ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে থাকে, তাদের ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির ঝুঁকি অনেক বেশি।
এই অবস্থায় রক্তে অতিরিক্ত শর্করা নার্ভের বাইরের সুরক্ষা স্তর, যাকে মায়োলিন শিট বলা হয়, সেটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ফলে নার্ভের কার্যক্ষমতা কমে যায় বা ব্যাহত হয়। মূল উপসর্গগুলোর মধ্যে হাতে এবং পায়ে ঝিনঝিন ভাব, অবসাদ, ব্যথা, এবং শক্তি হ্রাস লক্ষ করা যায়।
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি জন্য কারা ঝুঁকিতে রয়েছে?
১. বংশগত বা জিনগত ধারা
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির একটি প্রধান কারণ হতে পারে জিনগত প্রভাব। পরিবারের ইতিহাস থাকলে এ রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
২. অটোইমিউন ফ্যাক্টর
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে নার্ভাস সিস্টেম বা পেরিফেরাল নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা নিউরোপ্যাথির ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
৩. উচ্চ রক্তচাপ
উচ্চ রক্তচাপ স্নায়ুর স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ব্যাহত করতে পারে, যা ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির ঝুঁকি বাড়ায়।
৪. ডায়াবেটিসের সময়কাল
ডায়াবেটিস রোগী যত বেশি সময় ধরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত থাকেন, তাদের ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি থাকে।
৫. উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল
উচ্চ কোলেস্টেরল নার্ভ ও রক্তনালীতে ব্লকেজ তৈরি করে, যা নিউরোপ্যাথির ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
৬. অতিরিক্ত ওজন
শরীরের অতিরিক্ত ওজন নার্ভের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং নার্ভের কার্যক্ষমতা হ্রাস করে। এছাড়াও, অতিরিক্ত চর্বি রক্তনালীতে জমে নার্ভকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
৭. ধূমপান ও অ্যালকোহল
ধূমপান এবং অ্যালকোহল সেবন শরীরের নার্ভাস সিস্টেমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা নিউরোপ্যাথির ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
৮. শরীরে ভিটামিনের ঘাটতি
বিশেষ করে ভিটামিন বি১২-এর ঘাটতি নার্ভের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং নিউরোপ্যাথির উপসর্গ সৃষ্টি করে।
এই কারণগুলো নিয়ন্ত্রণে রেখে ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই সুস্থ জীবনযাপনের জন্য সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত চিকিৎসা, এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরি।
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির প্রকারভেদ
পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথের ১০০ টেরও বেশি প্রকার আছে যার প্রত্যেকটির নিজস্ব উপসর্গ আছে। যাদের নিম্নলিখিত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে যেমন-
মোটর নিউরোপ্যাথি
এটা স্নায়ুর ক্ষতি করে যা শরীরের পেশী এবং নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে যেমন হাত ও বাহন অর্চনা করা বা কথা বলা।
সেনসরি বা সংবেদনশীল নিউরোপ্যাথি
সেঞ্চুরি নার্ভ আমাদের শরীরের ব্যথা,তাপমাত্রা এবং হালকা ছোঁয়ার অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। সেঞ্চুরি নিউরোপ্যাথি এই নার্ভ গুলোকে আক্রান্ত করে।
অটোনোমিক নার্ভ নিউরোপ্যাথি
অটোমেমিক নার্ভ নিউরোপ্যাথিতে সেই সব নার্ভ বা স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত হয় যেগুলো আমাদের শ্বাস নেওয়া বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া সম্পন্ন করার কাজ করে থাকে যেটা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
এই নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
মিশ্র নিউরোপ্যাথি
দুই বা ততোধিক নার্ভ একসাথে আক্রান্ত হলে সেটাকে মিক্স নিউরোপ্যাথি বলে। যেমন: সেনসরি মটর নিউরোপ্যাথি।
এ ছাড়া আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকারভেদ রয়েছে। যেমন: প্রক্সিমাল নিউরোপ্যাথি, ফোকাল নিউরোপ্যাথি ,ডায়াবেটিক অ্যামিওট্রফি ইত্যাদি।
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি লক্ষণ
ডায়াবেটিস নিউরোপ্যাথির লক্ষণ সমূহ-
- হাত ও পা জ্বালাপোড়া করা
- অসাড়তা বা কোনো অনুভূতি না থাকা
- খোঁচা খোঁচা লাগা বা টিংলিং অনুভূতি
- মাংসপেশির দুর্বলতা বা শক্তি কমে যাওয়া
- অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা (যতটা হওয়া উচিত তার চেয়ে বেশি অনুভব করা)
- ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা বা দাঁড়িয়ে থাকতে সমস্যা
- অতিরিক্ত ঘাম হওয়া
- ব্যথা কম অনুভব করা
- পিঠে ব্যথা হওয়া
- হজমে সমস্যা বা পেটের অসুবিধা
- প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা
- রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া
- ত্বকের সমস্যা, যেমন ত্বক শুষ্ক বা ফেটে যাওয়া
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির এই লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে বাড়ে। যদি আপনার ডায়াবেটিস থাকে, বা এই লক্ষণগুলোর কোনো একটি থাকে, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
কিভাবে ডায়াবেটিস নিউরোপ্যাথি রোগটি নির্ণয় করা যায়
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির লক্ষণগুলো হলো –
শারীরিক পরীক্ষা (Physical Examination):
- পেশির শক্তি পরীক্ষা: আপনার পেশির শক্তি ঠিক আছে কি না, তা দেখা।
- তাপমাত্রা পরীক্ষা: শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক কিনা, তা দেখা।
- লাইট টাচ টেস্ট: শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হালকা স্পর্শ করে অনুভূতি পরীক্ষা করা।
- পেশির কম্পন দেখা: পেশিতে কম্পন বা কোনো অস্বাভাবিক নড়াচড়া আছে কিনা, তা পরীক্ষা করা।
অন্যান্য পরীক্ষা:
- ইলেক্ট্রোমিওগ্রাফি (EMG): পেশির কার্যকারিতা দেখতে একটা বিশেষ পরীক্ষা।
- নার্ভ কন্ডাকশন ভেলোসিটি (NCV): নার্ভের মাধ্যমে সংকেত কত দ্রুত যাচ্ছে, তা পরীক্ষা করা।
- আল্ট্রাসাউন্ড: শরীরের ভিতরের নার্ভ দেখতে সাউন্ড ওয়েভ দিয়ে পরীক্ষা করা।
- নার্ভ বায়োপসি: নার্ভের টিস্যু পরীক্ষা করা।
সাধারণ লক্ষণ:
- ব্যথা: জ্বলন্ত বা ছুরিকাঘাতের মতো তীব্র ব্যথা।
- অসাড়তা: কিছু অনুভব না করা।
- টিংলিং: শরীরে খোঁচা খোঁচা লাগা।
- পেশির দুর্বলতা: পেশি ঠিকভাবে কাজ না করা।
- সমন্বয়হীনতা: শরীরের চলাফেরায় ভারসাম্যহীনতা।
- পেশি ক্র্যাম্প: পেশি শক্ত হয়ে যাওয়া বা ব্যথা করা।
- তাপমাত্রা ও ব্যথার সংবেদনশীলতা: তাপমাত্রা বা ব্যথা বেশি বা কম অনুভব করা।
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি প্রতিরোধের উপায়
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি প্রতিরোধের অন্যতম সহজ এবং কার্যকর উপায় হলো জীবনধারায় পরিবর্তন আনা এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা। এটি শুধুমাত্র স্নায়ু ক্ষতি কমাতে সাহায্য করে না, বরং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা নিশ্চিত করতে সহায়ক। আসুন জেনে নিই কীভাবে ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি প্রতিরোধ করা যায়।
রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ
নিয়মিত ওষুধ সেবন এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে স্নায়ুর ক্ষতি কমবে। এটি ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির ঝুঁকি হ্রাসে সহায়ক হতে পারে।
খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন
তেল, চর্বি এবং কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাবার পরিহার করা উচিত। এই ধরনের খাবার স্নায়ুর ক্ষতি করতে পারে, তাই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি।
নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা
রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করা উচিত। এতে ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির ঝুঁকি কমে।
ব্যায়াম
নিয়মিত হাঁটা এবং শারীরিক কার্যকলাপ অব্যাহত রাখা স্বাস্থ্যের সামগ্রিক উন্নতি করতে সাহায্য করে। ব্যায়াম রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং স্নায়ু ক্ষতি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার
ধূমপান ও অ্যালকোহল নার্ভের ক্ষতি করে। ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি এড়াতে এগুলো থেকে দূরে থাকা জরুরি।
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির চিকিৎসা
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য হলো রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা, স্নায়ুর ক্ষয় রোধ করা এবং ব্যথা উপশম করা।
শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ
নিয়মিত ওষুধ সেবন, স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ এবং ব্যায়াম শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। এতে স্নায়ুর ক্ষতি কমে এবং ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির ঝুঁকি হ্রাস পায়।
ব্যথা উপশম
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথিতে হাত ও পায়ে জ্বালা, ব্যথা ও অসারতা হয়। ব্যথা উপশম করতে ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করা যেতে পারে।
শারীরিক থেরাপি
শারীরিক থেরাপি বা ফিজিওথেরাপি ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির লক্ষণগুলো কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও,ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি ঔষধ এবং ক্রিম বা ব্যথা নাশক প্যাঁচ ব্যথা উপশমে সহায়ক।
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথির ঘরোয়া চিকিৎসা কি কি
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঘরোয়া উপায়ে কিছু সাধারণ পরিবর্তন আনা যেতে পারে। রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম, এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবনের মাধ্যমে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তেল ও চর্বিযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত মশলাযুক্ত খাবার পরিহার করা উচিত। হাত ও পায়ের সঠিক যত্ন নিতে হবে এবং নরম ও পাতলা কাপড় এবং আরামদায়ক জুতা পরা উচিত, যাতে কোনো ধরনের অসুবিধা বা ক্ষতি না হয়। প্রতিদিন আধা ঘন্টা থেকে এক ঘন্টা হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুললে শরীর সুস্থ থাকে। ধূমপান পরিহার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি স্নায়ুর ক্ষতি বাড়াতে পারে।
বিস্তারিত জানুন: কোন ফল খেলে ডায়াবেটিস কমে? রোগীরা কোন ফল খাবেন না জেনে নিন!
বিস্তারিত জানুন: ডায়াবেটিসে মেথি খাওয়ার নিয়ম, মেথির উপকারিতা জেনে নিন!!
বিস্তারিত জানুন: পুরুষের ডায়াবেটিস হলে কি সন্তান হয়? শুক্রানু কাউন্ট কত?
তথ্যসূত্র
Mayo Clinic – Diabetic neuropathy
WebMD – What Is Diabetic Neuropathy?
National Institute of Diabetes and Digestive and Kidney Diseases – Diabetic Neuropathy
Cleveland Clinic – Diabetes-Related Neuropathy
Diabetes UK – Diabetic neuropathy (nerve damage)
Medical News Today – What to know about diabetic neuropathy
সাধারণ জিজ্ঞাসা
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি কি অনিবার্য?
ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি অনিবার্য নয়, তবে দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকলে এর ঝুঁকি বেড়ে যায়। নিয়মিত রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখা, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে এই সমস্যার সম্ভাবনা কমানো সম্ভব।