আজকের এই ব্লগ পোস্টে আমরা আলোচনা করবো একটি জনপ্রিয় ভেষজ উদ্ভিদ, সজনে পাতা, এবং এর ডায়াবেটিস রোগীর কাঁচা সজনে পাতার উপকারিতা সম্পর্কে। বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই সজনে পাতা এর পুষ্টিগুণের জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। তবে, ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সজনে পাতা কতটা উপকারী, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা জরুরি।
ডায়াবেটিসে গুড় খাওয়া যাবে কি?
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য গুড় খাওয়া ঠিক নয়। যদিও গুড় একটি প্রাকৃতিক মিষ্টি, তবে এতে থাকা উচ্চমাত্রার সুক্রোজ, ফ্রুকটোজ, এবং গ্লুকোজ ডায়াবেটিস রোগীদের শরীরে রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দিতে পারে। প্রতি ১০০ গ্রাম গুড়ে প্রায় ৩৮৩ ক্যালোরি থাকে এবং এতে ৬৫-৮৫% সুক্রোজ থাকে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এই পরিমাণ চিনি বিপজ্জনক হতে পারে। গুড় খেলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ দ্রুত বেড়ে যায়, যা শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের গুড় এড়িয়ে চলাই ভালো।
ডায়াবেটিস রোগীর কাঁচা সজনে পাতার উপকারিতা
সজনে পাতা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি ম্যালেরিয়া, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসসহ নানা ধরনের রোগ নিরাময়ে সহায়ক। নিয়মিত সজনে পাতা সেবনে শরীর আরও নানা উপকার পায় এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সজনে পাতায় প্রচুর ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন এবং প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড রয়েছে। এসব উপাদান শরীরের জন্য খুবই উপকারী। নিয়মিত সজনে পাতা খেলে আরও কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা পাওয়া যায়। চলুন সেগুলো দেখে নেই —
পুষ্টির পাওয়ার হাউজ
সজনে পাতা খুবই পুষ্টিকর! এতে অনেক ধরনের ভিটামিন ও খনিজ আছে যা আমাদের শরীরের জন্য খুবই দরকারি। প্রতি গ্রাম সজনে পাতা খেলে আমরা একটি কমলার চেয়ে ৭ গুণ বেশি ভিটামিন সি, ডিমের চেয়ে ২ গুণ বেশি প্রোটিন, দুধের চেয়ে ৪ গুণ বেশি ক্যালসিয়াম এবং গাজরের চেয়ে ৪ গুণ বেশি ভিটামিন এ পাই। এছাড়াও, এতে কলার চেয়ে ৩ গুণ বেশি পটাশিয়াম আছে। আয়রনের দিক থেকেও এটি খুবই শক্তিশালী, এমনকি পালং শাকের চেয়ে ৫ গুণ বেশি আয়রন আছে এতে। তাই, সজনে পাতা খেলে অন্ধত্ব, রক্তস্বল্পতা বা বিভিন্ন ভিটামিন ঘাটতির সমস্যা দূর হয়।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
সজনে পাতায় এমন কিছু উপাদান আছে যা রক্তে শর্করার মাত্রা ঠিক রাখে। এতে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও আইসোথিয়োকাইনেটস ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। প্রতিদিন ৫০ গ্রাম সজনে পাতা খেলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেক কমে যায়। বিশেষ করে যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তারা এই পাতার চা খেতে পারেন। এই পাতার চা রক্তে শর্করার মাত্রা কমায় এবং কোলেস্টেরলও নিয়ন্ত্রণে রাখে।
রক্তস্বল্পতা দূর করে
যাদের রক্তস্বল্পতা বা আয়রনের অভাব আছে, তাদের জন্য সজনে পাতা অত্যন্ত উপকারী। এতে শাকের তুলনায় ২৫ গুণ বেশি আয়রন থাকে, যা রক্তে আয়রনের ঘাটতি পূরণে সহায়ক। এছাড়াও, এতে কলার তুলনায় ৩ গুণ বেশি পটাশিয়াম রয়েছে, যা শরীরের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে সাহায্য করে। সর্বোত্তম ফল পেতে নিয়মিত সজনে পাতা, ডাঁটা ও ফুল খাওয়া উচিত।
ক্যান্সার প্রতিরোধে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট
সজনে পাতা অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের খনি হিসেবে পরিচিত। এতে বেটা-কেরোটিন, কিউরেকটিন ও ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড আছে, যা ক্যান্সারের কোষ গঠনে বাধা দেয়। এই ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড রক্তচাপ ও শর্করা কমাতেও সাহায্য করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
সজনে পাতা খেলে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এটি হরমোন বর্ধন করতে পারে এবং মায়েদের বুকের দুধও বাড়াতে পারে। এছাড়াও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে, মুখের রুচি বাড়াতে ও বিভিন্ন পেটের রোগ, যেমন ডায়ারিয়া ও আমাশয়ের সমস্যা সমাধানে সহায়ক। সাজিনার ডাঁটা ও পাতা কৃমিনাশক ও জ্বরনাশক হিসেবেও কাজ করে।
ব্ল্যাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
যাদের ব্ল্যাড প্রেসার আছে, তাদের জন্য সজনে পাতা খুবই ভালো। এতে সোডিয়াম ক্লোরাইড নেই বললেই চলে, যা ব্ল্যাড প্রেসারের রোগীদের জন্য ক্ষতিকর। তবে এতে পটাশিয়াম আছে, যা ব্ল্যাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
ত্বকের যত্নে সজনে পাতা
সজনে পাতার গুঁড়া বা তেল ত্বকের বলিরেখা ও দাগ দূর করতে সাহায্য করে। এটি ত্বককে উজ্জ্বল রাখে এবং ত্বকের কুঁচকে যাওয়া বা বয়সের ছাপ কমায়। নিয়মিত সজনে পাতা খেলে রক্ত পরিশ্রুত হয়, যার ফলে ত্বক পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যকর থাকে।
সজনে পাতার চা ও গুঁড়া বানানোর পদ্ধতি
সজনে পাতার চা তৈরি করা খুব সহজ। আপনি কাঁচা সজনে পাতা লাল চায়ের মধ্যে মিশিয়ে বা শুকিয়ে গুঁড়া করে চা বানাতে পারেন। নিয়মিত সজনে পাতার চা পান করলে শরীরের ক্লান্তি দূর হয় এবং শরীরকে শক্তি যোগায়। এতে থাকা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান শরীরকে বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
সজনে পাতা খাওয়ার সতর্কতা
সজনে পাতা অনেক উপকারী হলেও অতিরিক্ত খাওয়া ঠিক নয়। বেশি খেলে লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং অ্যালার্জির ঝুঁকিও থাকতে পারে। তাই, প্রতিদিন ৭ গ্রাম বা আধা চামচের বেশি না খাওয়াই ভালো।
ডায়াবেটিস রোগীর সজনে পাতার গুড়া খাওয়ার নিয়ম
সজনে পাতার গুঁড়া এক চা চামচ এক গ্লাস পানির সাথে মিশিয়ে বা চায়ের পাতার মতো ব্যবহার করে খাওয়া যায়। এতে থাকা আইসো থায়োসায়ানেট উপাদান রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে, যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। নিয়মিত সজনে পাতা খেলে অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নিঃসরণ বাড়ে এবং যারা ইনসুলিন গ্রহণ করেন, তাদের ইনসুলিনের মাত্রা কমাতে সহায়তা করে। এটি ডালে, শাক, স্যুপ বা সালাদের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যায় এবং শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ সরবরাহ করে। সজনে পাতার নিয়মিত সেবন রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বিস্তারিত জানুন: কোন ফল খেলে ডায়াবেটিস কমে? রোগীরা কোন ফল খাবেন না জেনে নিন!
বিস্তারিত জানুন: ভরা পেটে ডায়াবেটিস কত হলে নরমাল পয়েন্ট থাকে তা জেনে নিন!!
বিস্তারিত জানুন: পুরুষের ডায়াবেটিস হলে কি সন্তান হয়? শুক্রানু কাউন্ট কত?
তথ্যসূত্র
NDTV — Can Moringa Help Manage Diabetes?
WebMD — Health Benefits of Moringa
Science Direct — The effects of Moringa oleifera on blood glucose levels: A scoping review of the literature
National Center for Biotechnology Information — Effects of Moringa oleifera on Glycaemia and Insulin Levels: A Review of Animal and Human Studies
Health Shots — Diabetes: Can moringa help you manage your blood sugar levels?
সাধারণ জিজ্ঞাসা
সজনে পাতা খেলে কি প্রেসার কমে?
সজনে ডাঁটায় প্রায় কোনো সোডিয়াম ক্লোরাইড নেই, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক। সজনের তেল এবং সজনে পাতার গুঁড়া ত্বকের বলিরেখা ও ক্ষত দূর করতে কার্যকর। এটি ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে সহায়ক এবং ত্বকের কুঁচকানো ভাব, বলিরেখা ও বিভিন্ন দাগ ছোপ কমিয়ে ত্বককে মসৃণ ও উজ্জ্বল রাখে। নিয়মিত ব্যবহার ত্বকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
সজনে পাতার গুড়া খেলে কি ওজন কমে?
সজনে পাতায় প্রচুর পরিমাণে ফাইবার এবং ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড থাকে, যা প্রাকৃতিকভাবে ওজন কমাতে এবং শরীরে জমে থাকা চর্বি হ্রাস করতে সহায়ক। এজন্য সজনে-চা ওজন কমানোর ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া সজনে পাতায় ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম এবং ভিটামিন ই-এর মতো পুষ্টিগুণ রয়েছে, যা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
সজনে পাতা মুখে দিলে কি হয়?
সজনে পাতা ত্বকের যত্নে অত্যন্ত উপকারী। এটি বয়সের ছাপ এবং পিগমেন্টেশন দূর করতে সহায়ক। ব্রণ বা পিম্পল প্রতিরোধেও এর কার্যকারিতা দারুণ। এতে থাকা ভিটামিন সি ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায় এবং ত্বকের রং সমান করে। সজনে পাতার ব্যবহারে ত্বকে প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরি হয়, যা পোরের সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে। এটি ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রেখে শুষ্কভাব দূর করে, ফলে ত্বক হয় কোমল ও মসৃণ।