ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে খাবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে ফলের প্রাকৃতিক মিষ্টি এবং পুষ্টি আমাদের জন্য একটি দারুণ সহায়ক হতে পারে। নানা ধরনের ফলের স্বাদ, রঙ এবং পুষ্টি আমাদের শুধু স্বাদ উপভোগ করতে দেয় না, বরং রক্তে শর্করার মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
এই ব্লগে, আমরা এমন ফল সম্পর্কে জানব যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে। বিশেষ করে কোন ফল খেলে ডায়াবেটিস কমে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করব। আমরা গ্লাইসেমিক ইনডেক্স এবং ফাইবারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করব।
কোন ফল খেলে ডায়াবেটিস কমে?
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে খাবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ফল খাওয়ার সময় বুঝে শুনে খাওয়া দরকার, কারণ কিছু ফল রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দিতে পারে, আবার কিছু ফল ধীরে ধীরে শর্করার মাত্রা বাড়ায় এবং অনেকটা সময় ধরে রক্তে শর্করার স্তর স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে যেসব ফল উপকারী, সেগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে রাখা জরুরি।
ফল হলো পুষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এতে রয়েছে প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এই উপাদানগুলো শরীরকে বিভিন্ন রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং এমনকি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ফলের ধরন ও পরিমাণ নির্ধারণ করাটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ কিছু ফল শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।
১৩টি ফল যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে তা নিয়ে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
১. বেরি: ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি, রাস্পবেরি, ব্ল্যাকবেরি
বেরিগুলো যেমন ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি, রাস্পবেরি, ব্ল্যাকবেরি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত কার্যকরী। এগুলোতে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফাইবার, এবং ভিটামিন থাকে। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এগুলোর গ্লাইসেমিক সূচক (GI) কম। গ্লাইসেমিক সূচক মানে হলো কোন খাবার রক্তে শর্করার মাত্রা কত দ্রুত বাড়ায় তা মাপার একটি পদ্ধতি। GI কম থাকায় বেরি খেলে রক্তে শর্করা খুব দ্রুত বাড়ে না। বিশেষ করে ব্লুবেরি এবং স্ট্রবেরি অ্যান্থসায়ানিন নামক যৌগে ভরপুর, যা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। স্ট্রবেরি খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, হজমশক্তি উন্নত হয় এবং ওজন নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে।
২. আপেল
“একটি আপেল প্রতিদিন, ডাক্তারের প্রয়োজন নেই” – এই কথাটা কিন্তু সত্যি। আপেলে থাকা দ্রবণীয় ফাইবার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। আপেল খাওয়ার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে পেট ভরা থাকে, ফলে ক্ষুধা কম লাগে এবং শর্করার মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে থাকে। আপেল ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক, বিশেষ করে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে।
৩. নাশপাতি
নাশপাতি অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর একটি ফল। এর ফাইবারের পরিমাণ অনেক বেশি এবং এতে ধীরে হজম হওয়া শর্করা থাকে, যা রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখে। নাশপাতিতে থাকা ফাইবার হজমে সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি একটি আদর্শ ফল হতে পারে, কারণ এটি রক্তে শর্করার মাত্রা খুব দ্রুত বাড়ায় না।
৪. সাইট্রাস ফল: কমলালেবু, লেবু, জাম্বুরা
সাইট্রাস ফল যেমন কমলালেবু, লেবু, এবং জাম্বুরায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে। ভিটামিন সি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ফ্ল্যাভোনয়েড নামক উপাদান রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এগুলোতে দ্রবণীয় ফাইবারও রয়েছে, যা রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক। জাম্বুরায় ক্যালোরির পরিমাণ কম এবং এটি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে, তাই এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই ভালো ফল।
৫. চেরি
চেরিতে থাকা অ্যান্থসায়ানিন নামক যৌগটি রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে, ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এটি ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়াতে পারে এবং রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণকে সহজ করে।
৬. পীচ
পীচ এমন একটি ফল যা রক্তে শর্করার মাত্রা খুব বেশি বাড়ায় না। কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার এবং প্রয়োজনীয় ভিটামিন থাকে। পীচ খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী।
৭. বরই
বরইয়ের গ্লাইসেমিক সূচক কম, তাই এটি রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া, এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফাইবার রক্তে শর্করার মাত্রা ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। বরই খেলে শরীরে শক্তি যোগায় এবং ক্ষুধা কম লাগে।
৮. কিউই
কিউই একটি ফাইবার সমৃদ্ধ ফল, এবং এতে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কম। কিউইতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এর গ্লাইসেমিক সূচকও কম, তাই এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য একটি ভালো বিকল্প।
৯. এপ্রিকট
এপ্রিকটে ফাইবার এবং গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান থাকে, যা রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। এটি খেলে শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন যোগ হয় এবং রক্তে শর্করার স্তর নিয়ন্ত্রণে থাকে।
১০. পেঁপে
পেঁপেতে থাকা প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শুধু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেই সাহায্য করে না, বরং এটি হার্ট ও নার্ভের স্বাস্থ্যও ভালো রাখে। পেঁপে খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং শরীরে শক্তি যোগায়।
১১. পেয়ারা
পেয়ারা একটি অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর ফল। এতে লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স রয়েছে এবং প্রচুর ফাইবার থাকে, যা টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এটি হজমে সহায়ক এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।
১২. বেদানা
বেদানায় প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা ফ্রি র্যাডিক্যাল কমিয়ে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়। এছাড়া, বেদানা খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
১৩. আমড়া ও বাতাবি লেবু
আমড়া ও বাতাবি লেবু ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী টক জাতীয় ফল। এগুলোতে চিনি কম এবং আঁশ বেশি থাকে, যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। বাতাবি লেবু ভিটামিন সি সমৃদ্ধ এবং এটি রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে, আর আমড়া অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর, যা ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সাহায্য করে।
ডায়াবেটিস রোগীর জন্য কোন ফলের রস ভালো
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ফলের রস সবসময় উপকারী নয়। যদিও তাজা ফল বা রঙিন ফল স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, বেশিরভাগ ফলের রস রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। এতে থাকা ফ্রুক্টোজ (প্রাকৃতিক চিনি) এবং আঁশের অভাবের কারণে ফলের রস দ্রুত রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায়, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। ২৫০ মিলিলিটার চিনিমুক্ত কমলার রসে ১০০ ক্যালরি থাকে, যা একটি আস্ত কমলার তুলনায় বেশি। ফলের রসের গ্লাইসেমিক ইনডেক্সও অনেক বেশি, যা রক্তে গ্লুকোজ দ্রুত বাড়ায়। আস্ত ফলের তুলনায় ফলের রসে আঁশের পরিমাণ খুবই কম থাকে, যা আমাদের শরীরে গ্লুকোজ উৎপন্ন করে না এবং রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। তাই, ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ফলের রস খাওয়া উপকারী না হলেও, হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তে গ্লুকোজ কমে যাওয়া) হলে তাৎক্ষণিকভাবে রক্তে শর্করা বাড়াতে ফলের রস উপকারী। গবেষণা বলছে, সপ্তাহে তিনবার বা তার বেশি ফলের রস পান করলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ৮ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে, তবে ব্লুবেরি, আপেল এবং নাসপাতি খেলে ঝুঁকি কমে। তাই, ডায়াবেটিস রোগীদের ফলের রসের পরিবর্তে আস্ত ফল খাওয়া উচিত, বিশেষ করে ব্লুবেরি, সবুজ আপেল, এবং অন্যান্য টক ফল যেমন: আমড়া ও বাতাবি লেবু।
বিস্তারিত জানুন: ডায়াবেটিস কি?
বিস্তারিত জানুন: ডায়াবেটিস ফুট আলসার
বিস্তারিত জানুন: পুরুষের ডায়াবেটিস হলে কি সন্তান হয়? শুক্রানু কাউন্ট কত?
তথ্যসূত্র
WebMD – What Are the Best Fruits for Diabetes?
Diabetes UK – Fruit and diabetes
সাধারণ জিজ্ঞাসা
খাওয়ার ২ ঘন্টা পর ব্লাড সুগার কত হওয়া উচিত?
আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ডায়াবেটিস রোগীদের উপবাসের সময় রক্তে শর্করার লক্ষ্য মাত্রা ৩.৯ থেকে ৭.২ mmol/L (৭০ থেকে ১৩০ mg/dL) হওয়া উচিত। আর খাবারের দুই ঘণ্টা পরে রক্তে শর্করার মাত্রা ১০ mmol/L (১৮০ mg/dL) এর কম থাকা উচিত।
কি পাতা খেলে সুগার কমে?
সবুজ নিম পাতা চিবিয়ে খেলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। চিকিৎসক সর্বেশ কুমারের মতে, তুলসী পাতা সুগার নিয়ন্ত্রণে খুবই উপকারী, কারণ এতে অ্যান্টি-ডায়াবেটিক উপাদান থাকে যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। আয়ুর্বেদের মতে, স্টেভিয়া উদ্ভিদ থেকে প্রাকৃতিক মিষ্টি পাওয়া যায়, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ভালো।
ডায়াবেটিস কত বছর বয়সে হয়?
এই ধরনের ডায়াবেটিসের জন্য বাহ্যিক কোনও কারণ সাধারণত দায়ী থাকে না। এটি মূলত শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ার কারণে ঘটে। সাধারণত তরুণ বয়সে, বিশেষ করে ১৮ বছরের আগে এটি দেখা দেয়। এই ধরনটি টাইপ ১ ডায়াবেটিস নামে পরিচিত, যেখানে রোগীর শরীর ইনসুলিন তৈরি করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়। ইনসুলিন হলো এমন একটি হরমোন যা শরীরের রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
টাইপ ১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে রোগীর প্রতিরোধ ক্ষমতা ভুলবশত প্যানক্রিয়াসের ইনসুলিন তৈরি করা কোষগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে। এর ফলে শরীরে একেবারেই ইনসুলিন থাকে না। এই রোগের জন্য রোগীদের প্রতিদিন ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। ইনসুলিন ছাড়া, রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়, যা দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগ, কিডনির সমস্যা এবং স্নায়ুর ক্ষতি করতে পারে। তাই, রোগ নির্ণয়ের পরপরই উপযুক্ত চিকিৎসা এবং নিয়মিত ইনসুলিন নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।